কখন যে সূর্য ডুবে গেল খেয়ালই করিনি। অথচ গত দুই ঘণ্টায় এক কিলোমিটার পথও পার হইনি। সামনে জানামতে নিকটতম আশ্রয় বোর্ডিং হেডম্যানপাড়া। হিসাব মতে এখনো চার কিলোমিটার দূরে। সে তুলনায় পেছনের আব্রু হেডম্যানপাড়া কাছে, দুই কিলোমিটার হবে। কিন্তু দিনের আলোয় যে পথ পার হতে চার ঘণ্টা লেগেছে, রাতের অন্ধকারে তা পার হওয়ার মতো বীর কেউ নেই দলে। আর সামনের রাস্তা যদি পেছনেরটার মতো হয় তাহলে এই রাতে এগোনো স্রেফ পাগলামি। দুই পাশে খাড়া দেয়ালের মতো উঠে গেছে পাহাড়। জঙ্গলও এত ঘন যে আকাশটা দেখা যাচ্ছে কদাচিৎ। কাঁধের ব্যাগ মাংস চেপে বসে যেতে চাচ্ছে। শরীর ভিজে একসা। শীতে কাঁপতে শুরু করেছে সবাই। আমরা আটজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছি এক ঝিরির (পাহাড়ি খাল) মাঝখানে। তাপমাত্রা কমছে দ্রুত। এখন দরকার একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই আর কিছু গরম খাবার। ৩০ ডিসেম্বর, ২০০৯। সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিট।
আমরা বান্দরবানের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছি ২৪ তারিখ রাতে। পরিকল্পনা ছিল থানচি থেকে সাঙ্গু ধরে যত দূর এগুনো যায়। ২৫ তারিখ নৌকা নিয়ে রওনা দিয়ে তিন্দু, রেমাক্রি, ছোট মদক হয়ে তৃতীয় দিন বড় মদক পৌঁছাই। বিডিআর আর যেতে দিল না বলে ২৯ তারিখে আবার থানচি আসি। আমাদের হাতে তখনো চার দিন। মাসখানেক আগে আমরা গুগল ম্যাপ নিয়ে বসেছিলাম। তাজিংডং যাওয়ার একটা বিকল্প পথ খুঁজে পেয়েছিলাম। রাব্বি ভাই সে কথা মনে করিয়ে দিতে আমরা হিসাব করে দেখি ‘সম্ভব’। পথের ঝিরিটার নাম পদ্মঝিরি। এটি আমাদের বোর্ডিং হেডম্যানপাড়া পর্যন্ত সঙ্গ দিয়েছিল। থানচি থেকে পদ্মঝিরির মুখ পর্যন্ত যেতে নৌকায় দুই ঘণ্টা লেগেছিল। ঝিরির পানিতে নেমে দেখি ভীষণ ঠাণ্ডা। একটু এগুতেই দেখি পাহাড়ের গা ঘেঁষে একটি লম্বা বাঁশের হাতলছাড়া সাঁকো। পাহাড়ের গায়ে হাত রেখে চলতে হয়। ঝিরিতে বেশির ভাগ জায়গায় পানি কোমর সমান। এক জায়গায় ফয়সাল ভাই হাতের ছয় ফুট লম্বা লাঠিটা দিয়ে মাপতে চাইলেন, তল পেলেন না। ঝিরি থেকে পাহাড় যখন দূরে সরে যায় তখন অবশ্য পথও মেলে। ছায়াঘেরা এক জায়গায় বিরতি নিলাম। শুকনো খাবার খেয়ে যখন চা চড়াতে যাব তখন বুঝতে পারি চুলা ফেলে এসেছি থানচিতে।
আবার চলা শুরু। আশপাশে কিছু গ্রাম পড়ল। নাম জেনে জিপিএসে তুললাম। নাম জানাটা অবশ্য সহজসাধ্য ছিল না। স্থানীয়রা বাংলা জানেই না। আবু বকর ভাই ইশারা-ইঙ্গিতে কিভাবে যেন উদ্ধার করে। সাড়ে ৩টা নাগাদ পৌঁছাই আব্রু হেডম্যানপাড়ায়। রাব্বি ভাই ঘুমাতে চাইলেন। দেরি হয়ে গেলে বোর্ডিং হেডম্যানপাড়ায় মুরগি পাওয়া যাবে না বলতেই উঠে দাঁড়াল। জিপিএসের হিসাবে আমরা অর্ধেকের বেশি চলে এসেছি। এই গতি থাকলে ৭টা নাগাদ পৌঁছে যাব।
হঠাৎ করেই রাস্তা চেহারা বদলাতে শুরু করল। ঝিরিকে মাঝখানে রেখে পাহাড় চেপে আসা শুরু করল। ঝিরির পাথরের পরিমাণ ও আকার বড় হতে থাকল। জঙ্গলও বাড়তে থাকল। এর মধ্যে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। রাব্বি ভাই জিপিএস-এর ট্রপোগ্রাফিক ম্যাপে বের করল ঝিরি ধরে আছে অনেক বড় বড় গর্ত। রোদের অভাবে সব জায়গায় শ্যাওলায় ভরা। সুতরাং আছাড় খাওয়া চলল। এবার ঝিরিতে হাঁটাই যাচ্ছে না। এগুতে হচ্ছে পাহাড়ের গায়ের কার্নিশ ধরে। এবার যাব কোথায়? সামনে হঠাৎ পাথরের দেয়াল এসে হাজির। রাব্বি ভাই জিপিএস দেখে বলল, সামনে দুইটা বেশ বড় গর্ত আছে। ফয়সাল ভাইকে একটা পাথরের ওপর ওঠানো হলো। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বললেন অন্য পথ খুঁজতে হবে। অন্য পথ বলতে ফিরে যাওয়া অথবা পাহাড় দিয়ে রাস্তা বের করা। পাহাড়ে রাস্তা খোঁজ করাই সাব্যস্ত হলো। আমাদের ইচ্ছা পাহাড় পেরিয়ে আবার ঝিরিতে নামা। রাস্তা একটা পাওয়াও গেল। কিন্তু কিছু দূর গিয়ে রাস্তাটি দুই ভাগ হয়ে গেছে। একটা পথ ধরে এগিয়ে দেখি তা ঝোপের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছে। পিছিয়ে এসে বসে পড়লাম। হাসান ভাই কিছুক্ষণ পরে রাস্তা খুঁজে নিয়ে এলেন। বিসমিল্লাহ বলে উঠে দাঁড়ালাম। সামনেই পাথরের দেয়াল আবার, প্রথমটার মতো বড় না এটা। একজন একজন করে হাঁচড়েপাঁচড়ে পার হলাম। কিন্তু একি! একটার পর একটা পাথর পড়তেই থাকল। আর কত…অবশেষে সাড়ে সাতটা নাগাদ পাথরের চাতালের মতো এক জায়গায় পেঁৗছলাম। চাঁদটা আছে বলেই চলা যাচ্ছে। ৮টা বাজল, সাড়ে ৮টাও বাজল। ঠিক হলো আরো আধা ঘণ্টা আমরা এগুব। আমরা যেন কলম্বাস। হঠাৎই আবদুল্লা ভাই চিল্লানি দিলেন_গ্রাম দেখা যাচ্ছে বাহে। অগ্রবর্তী বাহিনী আবু বকর ও কোরায়েশি ভাই খবর জানতে গেল। সেটি ছিল এক মুরং পাড়া। নাম মেন্থন পাড়া। এখান থেকে বোর্ডিং হেডম্যানপাড়া এক ঘণ্টার পথ_ঝিরি ধরে যাওয়া যায়, পাহাড় ধরেও। আমাদেরকে পাড়ার লোকজন রাতটা কাটিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিল। কিন্তু আমরা তখন গন্তব্যে পৌঁছতে উন্মুখ। দেখেই ছাড়ব ভাব নিয়ে হাঁটা দিলাম পাহাড়ি পথে। শুরু হলো খাড়াই। রাস্তা বুঝি চাঁদে গিয়ে শেষ হবে। রাব্বি ভাই একপর্যায়ে বলেই ফেললেন, ‘মেন্থনপাড়ার মুরগিগুলো ডাকছে, চলো ফিরে যাই।’ অগ্রবর্তী দল পাঠানো হলো। তারা যা রিপোর্ট দিল তাতে পরিস্থিতি সুবিধের মনে হলো না। আহারে মেন্থনপাড়ার মুরগিগুলো বুঝি আর বাঁচল না! কারবারির বাড়িতে এসে আশ্রয় নিলাম। রান্না করতে গিয়ে দেখা গেল মসলার পোঁটলাও ফেলে এসেছি। ছেঁচা মসলা দিয়ে মুরগি হলো, সঙ্গে পাওয়া গেল জুমের ভাত।
পরদিন ভোরে নুডলস খেয়ে রওনা দিয়ে বোর্ডিংপাড়ায় পেঁৗছতে লেগেছিল পাঁচ ঘণ্টা। একেই বলে এক ঘণ্টা! পাড়ার ঝিরিতে গোসল করে আর দেরি করলাম না। এখন সোজা ১৩০০ ফুট উঠতে হবে। প্রতি ১০০ ফুট পর পর ৫ মিনিট বিশ্রাম নিয়ে শেরকরপাড়ায় উঠে এলাম ৫টা নাগাদ। আজ ৩১ ডিসেম্বর বলে সবাই ব্যস্ত। আমাদের হাতে ঘর-চুলা ছেড়ে সবাই চলে গেল গির্জায়। রাতে মিলল সেদ্ধ মুরগির মাংস আর কুমড়া ভাজা। পরদিন সকালে উঠেছিলাম তাজিংডং চূড়ায়।
২২ নভেম্বর ২০১০, অন্যকোনখানে A টু Z, কালের কণ্ঠ