
ছবি: সাখাওয়াত হোসেন হাওলাদার
কাক (এশীয় শিল্প ও সংস্কৃতি সভা)-এ কাজে ঢোকার পর জীবনের মোড় ঘুরে গেলো। সেখানকার প্রতিটি মানুষ একেকজন সৃষ্টিকর্তা। কেউ ছবি সৃষ্টি করে, কেউ চলচ্চিত্র সৃষ্টি করে, কেউ গান, কেউ কবিতা। যে যার জায়গা থেকে যা ভালো লাগে তাই নিয়ে কাজ করে। সেখানে ঢোকার পর প্রায় সাত দিন পর কচি ভাইয়ের সাথে দেখা। কচি ভাই কাকের সাধারণ সম্পাদক। ভাইয়াই ডেকে নিয়ে গেলেন তাঁর রুমে। অনেক কথা জিজ্ঞেস করার মাঝে বললেন, ‘এখানে অনেক কিছু করার সুযোগ আছে। যা ইচ্ছা করো, যদি মনে করো পড়ালেখা শুরু করতে চাও করতে পার। কোন কিছু প্রয়োজন হলে বলবা। যা ইচ্ছা হয় কর, এখানে অনেক কিছু করার সুযোগ আছে।’
এত সৃষ্টিশীল কাজ দেখার পর মাথা খারাপ হওয়ার মতোই অবস্থা। আমার সারাদিন কাটে বিভিন্ন কাজ করে, পত্রিকা পড়ে আর বই পড়ে। প্রথমে কয়েকদিন কিছুটা জড়তার মধ্যেই কাটছিলো, কারো সঙ্গে তেমন কথা বলতাম না। যদিও আমি সবসময় একটু চুপচাপ। কিছুদিন যাওয়ার পর মোটামুটি সাহস হলো। রাসেল ভাইয়ের সঙ্গে তখন রাতে বসে বসে প্রুফ দেখি। আমি মূল লেখা দেখে পড়ি আর রাসেল ভাই প্রুফ কপি দেখে দেখে কাটেন। কাজ করতে করতেই মাথার মধ্যে নানা রকম প্রশ্ন আসে, কিন্তু কাউকেই জিজ্ঞেস করা হয় না।
একদিন সাহস করে রাসেল ভাইকে প্রথম প্রশ্ন করলাম, ‘‘রাসেল ভাই “”দর্শন”” মানে কি?’’ রাসেল ভাই প্রশ্ন শুনে হেসে দিলেন। পাশ দিয়ে কচি ভাই যাচ্ছিলেন, কচি ভাইকে বললেন, ‘শরীফ আমার কাছে প্রশ্ন করেছে, দর্শন মানে কি?’ রাসেল ভাইয়ের কথা শুনে কচি ভাইও হাসলেন। পরবর্তীতে রাসেল ভাই উত্তর দিলেন, ‘’সাধারণ অর্থে “দর্শন” মানে দেখা। আরো যদি গভীর ভাবে চিন্তা করো, তাহলে শুধু দেখা না। সকল কিছু দিয়ে দেখা মানে সকল ইন্দ্রিয় দিয়ে দেখা বা অনুভব করা। চোখ দিয়ে, নাক দিয়ে, কান দিয়ে সকল ইন্দ্রিয় দিয়ে দেখা, শোনা, অনুভব করা।’’ এভাবেই শুরু হয় রাসেল ভাইয়ের কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা, কোনদিন বই পড়তে গিয়ে কোন কিছু না বুঝতে পারলে ফোন দিতাম রাসেল ভাইয়ের বাসার টিএনটি ফোনে। তখনও রাসেল ভাই মোবাইল ব্যবহার করেন না। এমনও হয়েছে ফোনে আমরা এক ঘণ্টা বা দেড় ঘণ্টাও কাটিয়ে দিয়েছি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলে।

ছবি: ইন্টারনেট
আমার বই পড়া বা অন্য কিছু অভ্যাসের মধ্যেও আরেকটা ছিলো গান শোনা। আমার কাছে শিরোনামহীনের প্রথম এ্যালবাম ‘’জাহাজী’’ টা ছিলো। কিন্তু জাহাজী এ্যালবামের অনেক গান আমি বুঝতাম না। একদিন রাসেল ভাইকে সিডিটা দিলাম এবং জিজ্ঞেস করলাম, এই ব্যান্ডের গান শুনেছেন কিনা? ‘তিনি উত্তরে ‘না বললেন।’’ আমি তাকে বললাম বাসায় গিয়ে ভালোমতো কয়েকটা গানের অর্থ বুঝেন কিনা দেখেন যদি বুঝেন আমাকে একটু বইলেন। রাসেল ভাই সিডি নিয়ে গেলেন এবং শুনলেনও। শোনার পরে আমাকে সিডি ফেরত দেয়ার পরে বললেন, ‘তুমি এই গান কই পাইলা? আগে শুনি নাই। তবে গানগুলা খুবই ভাল। যাই হোক তুমি যেই গানগুলার কথা বলেছিলে, সেই গানগুলো আমি বুঝি নাই। তবে গানগুলো অনেক ভালো গান।’
পরবর্তীতে কোন একদিন প্রশ্ন করেছিলাম কচি ভাইয়ের কাছে। কচি ভাইয়ের কাছেও অনেক রকম প্রশ্ন করতাম। এর মধ্যে কচি ভাইয়ের কাছে প্রথম প্রশ্ন ছিলো লালনের গান নিয়ে। লালনের ‘বাড়ির কাছে আর্শিনগর’ গানটি নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। যদিও সেদিন তাঁর কাছ থেকে এর উত্তর পাইনি। সেই দিন এর উত্তর না পেলেও, কচি ভাইয়ের কাছ থেকে অনেক কিছু প্রশ্ন করে শিখেছি, জেনেছি।
অফিসে প্রায়ই শওকত ভাই ইলাস্ট্রেটরে গ্রাফিক্সে কাজ করতেন। কাজ করার পাশাপাশি, আমার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নানা রকম কথা বার্তা হতো। প্রায়ই শওকত ভাই বলতো, ‘’বলো তো, কার বুদ্ধি বেশি? আমার না রাসেল ভাইয়ের?’’ অথবা ‘’কচি ভাইয়ের না স্যারের?’’ এই কথা শুনতে শুনতে একদিন মাথার মধ্যে প্রশ্ন আসলো, ‘আসলে বুদ্ধি কি?’

ছবি: সাখাওয়াত হোসেন হাওলাদার
একদিন সাহস করে সলিমুল্লাহ স্যারকে প্রশ্ন করে বসলাম, ‘‘স্যার, বুদ্ধি কি?’’ স্যার আমার দিকে তাকিয়ে হেসে উত্তর দিলেন, ‘’স্যার, আপনি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন করেছেন। সহজ কথায় যদি বলি ““বুদ্ধি”” আসছে “”বুঝা”” থেকে। আরো যদি ব্যখ্যা করে বলি, ধরেন আপনি একটা সমস্যায় পড়েছেন, আপনি সঙ্গে সঙ্গে সেই সমস্যার সমাধান করে ফেলেছেন। তার মানে আপনি বুদ্ধিমান। আবার ধরেন আপনি কম্পিউটারে একটা কাজ করছেন, কম্পিউটারে একটা সমস্যা হয়েছে, আপনি সমস্যাটা সমাধান করে ফেলেছেন। এখন এই যে কম্পিউটারের সমস্যাটা কোথায় আপনি বুঝতে পেরেছেন বলেই আপনি সহজে সমাধান করতে পেরেছেন। সমস্যাটা যে আপনি বুঝতে পেরেছেন এটাই হলো ‘বুঝা’। আর “”বুঝা”” মানেই ““বুদ্ধি”””।’ স্যারের কাছে এই ধরনের অনেক কঠিন প্রশ্ন করে সহজ উত্তর পেয়ে জেনেছি, শিখেছি।
এভাবেই প্রতিনিয়ত প্রতিটি মানুষের কাছেই প্রশ্ন করে শেখা যায়। শিখতে চাইলে প্রশ্নের কোন বিকল্প নেই।
ভালো লাগলো, কাকা নিয়ে আরো লিখা তোমার কাছ থেকে চাই
কাক হবে
ধন্যবাদ বাবু ভাই। আরো লিখবো, এখানে ২/৩ লিখিছি পইড়েন।