৬৪ জেলায় যা দেখেছি–২৮

২৮ মার্চ (পাবনা থেকে কুষ্টিয়া)

ভোরে রওনা দিলাম পাবনা থেকে। ভোরের আলোতেই প্রথমে দেখা পেলাম আরেকদল স্কাউটের। চাপাই রাজশাহীর পথে যে গ্রুপটার সঙ্গে দেখা হয়েছিল সেই রকমই তবে এই গ্রুপের সদস্য সংখ্যা একজন বেশি। আমি দেখেই বুঝতে পারলাম এঁরা একশ মাইল হাঁটার জন্য বের হয়েছেন। তাই আর গত গ্রুপের ছেলেদের মতো এঁদের অত বেশি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হলো না। উনাদের এবং আমার দুই দলের ভ্রমণেই এই স্মৃতির একটি পাতায় যুক্ত হলো।

প্রায় বিশ কিলোমিটারের মত রাস্তা পার হওয়ার পর একটি গোলচত্বর পেলাম। একটি রাস্তা চলে গেছে ঈশ্বরদী অন্যটি লালন সেতু হয়ে কুষ্টিয়ার দিকে। গোলচত্বরের পাশেই একটা দোকানে সকালের নাস্তা করলাম। পাবনা থেকে কুষ্টিয়া যাওয়ার দুইটি রাস্তা ছিল। একটি পাবনা শহর থেকেই কিছুদূর গেলে নদী পার হয়ে কুষ্টিয়া চলে যাওয়া যায়। সেটা অপেক্ষাকৃত দূরত্ব কম, দূরত্ব কম হলেও আমি ঐ রাস্তাটি এরিয়ে আসলাম। একটাই কারণ হার্ডিঞ্জ ব্রিজটা দেখা আর লালন সেতুর উপর দিয়ে যাওয়া। লালন সেতুটি নতুন হলেও প্রায় একশ বছরের কাছাকাছি বয়সের হার্ডিঞ্জ সেতুটির কথা অনেক শুনেছি এবং কিছু বইপত্রেও পড়েছি। তাই এটা না দেখে যেতে ইচ্ছা করছিল না।

নাস্তা করার পর যখন লালন সেতুতে উঠতে যাব প্রথমেই একটা বাঁধা পেলাম। লালন সেতুর দায়িত্বে থাকা সিকিওরিটি গার্ড আমাকে আটকে দিল। বলে দিলেন এই সেতুতে সাইকেল চালানোর নিয়ম নেই। অনেক সেতুতেই সাইকেল চালানোর অনুমতি নেই এই বিষয়টা আমার জানা ছিল। তবে সেতুর দায়িত্বে থাকা ইঞ্জিনিয়ারের কাছে অনুমতি নিলে সেতু পার হওয়ার অনুমতি দেয়া হয় এটাও আমি জানি।

জিজ্ঞেস করলাম দায়িত্বে থাকা ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আছেন কিনা। তিনি জানালেন ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আসবেন দশটার দিকে। ইঞ্জিনিয়ার যদি আমাকে অনুমতি দেন তো তাঁর আমাকে সেতুতে উঠতে দিতে আপত্তি নেই। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম মাত্র সাতটা বাজে, অর্থাৎ দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এতক্ষণ অপেক্ষা করতে ইচ্ছা করতেছিল না।

বাদশাহ ভাই
বাদশাহ ভাই

সিকিওরিটি গার্ডের সঙ্গে গল্প করা শুরু করলাম। উনার নাম বাদশা, অনেকদিন যাবত এখানে চাকরি করেন। বাদশাহ ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে পারলাম হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দিয়েও এখন আর মানুষজন চলাফেরা করতে দেয়া হয় না। আমার একমাত্র উপায় অন্য কোন জানবাহন দিয়ে সেতু পার হওয়া।

বাদশাহ ভাই-ই আমাকে একটি খালি অটো দেখে আমাকে তুলে দিলেন। অটোরিক্সাওয়ালা বেশ ভাল ছিল, সেতুতে উঠার পর গাড়ি থামিয়ে আমাকে দুয়েকটি ছবি তোলারও সুযোগ করে দিয়েছিলেন। লালন সেতুর উপর থেকে হার্ডিঞ্জ ব্রিজটাও দেখা যাচ্ছিল। সেতু পার হওয়ার পরে আমার কাছ থেকে ভাড়াও নিলেন না অটোওয়ালা। আমি জোর করেও তাকে ভাড়া দিতে পারি নাই। উনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা দিলাম কুষ্টিয়ার পথে।

পাঁচ কিলোমিটার পথ যাওয়ার পরেই র‌্যাবের একটি গ্রুপ আমাকে থামালেন। নানা রকম প্রশ্নের উত্তর দিতে হল। পুরা দলের যে কমান্ডার ছিলেন তাঁর ব্যবহার বেশ ভাল ছিল। কিন্তু তার সাঙ্গোপাঙ্গোদের ব্যবহার আমাকে আসাহত করলো। কিছুটা মেজাজও খারাপ হচ্ছিল উনাদের ব্যবহারে। যেমন উনাদের দলনেতার সঙ্গে কথাবলার মাঝখানেই একজন পেছন থেকে বলে উঠলেন, স্যার ব্যাগ তল্লাশি করি। আরেকজন বলছিলেন, স্যার গাড়িতে তুলে ফেলি। শেষ পর্যন্ত আমাকে গাড়িতেও তুলেন নাই আর ব্যাগও তল্লাশি করেন নাই। এমনিতেই ছেড়ে দিলেন। মনে হচ্ছিল আমাকে তারা একটু বাজিয়ে দেখলেন।

46889_1543980329337_5247936_nর‌্যাব ভাইদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি আবার যাত্রা শুরু করলাম। পথে বেশ কয়েকটা জায়গায় ছোট ছোট ঘরের মতো দেখছিলাম, উপর দিয়ে ধোয়া বের হয়। এই রকম আরো কয়েকটা ঘর দেখার পর, কৌতুহলী হয়ে একটা ঘরের সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম এখানে কি করে। তিনি আমাকে বুঝিয়ে দিলেন এখানে তামাক গরম করা হয়। তামাক চাষীরা তামাক গরম করে প্রকিয়া করার উপযুক্ত করে থাকেন। তাই অনেক বাড়ির সামনেই এই ধরনের ঘর দেখতে পাওয়া যায়। তিনি আমাকে খুব ভালমত দেখালেন এটা কিভাবে কি করে এবং কিভাবে উনারা কাজ করেন। এখানকার অনেকেই তামাক চাষ করেন বুঝা গেল।

কুষ্টিয়াতে থাকার ব্যবস্থা হল আমিনুর নামে একজনের বাসায়। শহরে ঢুকে উনাকে ফোন দেয়াতে উনি বলে দিলেন লাভলী টাওয়ারের সামনে যেতে। লাভলী টাওয়ারের সামনে যাওয়ার পর মনে হল কুষ্টিয়া শহরের কেন্দ্র এই লাভলী টাওয়ার। বিল্ডিংটি দশ তলা, কুষ্টিয়া শহরে এইটাই সবচাইতে বড় বিল্ডিং। এই টাওয়ার জুড়ে লোকজনের অনেক কর্মচঞ্চল। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরেই আমিনুর ভাই হাজির হলেন। কথাবার্তা বলে রওনা দিলাম উনার বাসার দিকে।

উনি একটি রিক্সা নিলেন আর আমি পেছন পেছন সাইকেলে। উনার বাসায় যাওয়ার পর বিশ্রাম তারপর খাওয়াদাওয়া। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলেন, আমার প্ল্যান কি? আমি বললাম, শহর দেখবো, লালনের আখড়া দেখবো আর বিখ্যাত কি আছে তা খাব। তিনি আমাকে বাসায় রেখে চলে গেলেন তাঁর অফিসে বলে গেলেন বিকালের মধ্যেই ফিরে আসবেন। আমি বিশ্রাম নিতে নিতে এক সময় ঘুমিয়ে গেলাম। বিকালের দিকে আমিনুর ভাই আমাকে ডেকে তুললেন।

বিকেলে আমরা দুইজনে বের হলাম লালনের আখড়া দেখতে। একটি ভ্যান নিয়ে দুইজনে চলে গেলাম সরাসরি সেখানে। লালনের মাজার, লালন যাদুঘর দেখে আমরা আখড়ার পাশে নদীর পাড়ে বসে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটালাম। আমরা আবার শহরে ফিরে আসলাম। একটি মিষ্টির দোকানে ঢুকলাম। আমিনুল ভাই জানালেন রসকদম এখানকার জনপ্রিয় খাবার। দুইজনে মিলে রসকদম খেলাম। তারপর হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম পাবলিক লাইব্রেরির সামনে। লালনের গান চলছিল, দুইজনে মিলে কিছুক্ষণ গান শুনলাম।

আমরা অনেকটা বিরক্তি নিয়েই বের হয়ে আসলাম। গিটার-ড্রামে লালনের গান খুব একটা জমলো না। আমিনুর ভাইও বললেন লালনের গানের আসল বৈশিষ্ট্যই হলো গলা আর গানের কথা। এখানে আধুনিক যন্ত্রের শব্দে মূল মজাটাই নষ্ট হয়ে গেছে। তবে তিনি আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখলেন আমি যেন লালন মেলায় আসি তাহলে ভালমত গান শুনতে পারবো।

11794572864_e264acdd05_k
লালনের মাজারের সামনে

আমিনুর ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে পারলাম কুষ্টিয়া জেলা শহরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান লেগেই থাকে। রবীন্দ্রনাথ আর লালনের কারণে এই সাংস্কৃতিক ছোয়া লেগেছে। প্রতি মাসেই কোন না কোন অনুষ্ঠান থাকে। আমরা বাসায় ফিরে এসে দেখি বিদ্যুৎ নেই। উনাদের বাসার সামনে একটা খোলা মাঠ ছিল সেখানে বসে আমরা গল্প করলাম অনেক্ষণ।

কথায় কথায় আমিনুর ভাইয়ের কাছে সর্বহারা পার্টি সম্বন্ধে জানতে পারলাম। এখন এলাকার অবস্থা ভাল। তবে আগে খুবই খারাপ ছিল অবস্থা। প্রায়ই এই পার্টির লোকজন মানুষজনদের খুন করতো। আমার সর্বহারা পার্টি সম্বন্ধে খুব একটা ভাল ধারণা ছিল না। তবে এখানে এসে মোটামুটি একটা ধারণা পেয়ে গেলাম।

সর্বহারা পার্টির কার্যক্রম ছিল অনেকটা রবিনহুটের মতো। সেটা প্রথম দিককার ঘটনা। এদের কাজ ছিল বড় বড় ব্যবসায়িদের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে গরিব মানুষদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া। কিন্তু একটা সময় টাকা-পয়সা নিয়ে নিজেদের মধ্যে কোনদল শুরু হয়। তারপর নিজেদের পার্টি অনেকগুলা ভাগ হয়ে যায়। এখন আর আগের সর্বহারা পার্টি নাই, গরিব মানুষদেরও এরা টাকা পয়সা দেয় না। এরা এখন ব্যস্ত নিজেদের মধ্যে মারামারি আর লুটতরাজ নিয়ে।

কথা বলতে বলতেই এক সময় বিদ্যুৎ চলে আসলো। আমরা যখন গেট দিয়ে ঢুকতেছি তখন পাশের বাসা থেকে একটি মেয়ে আমিনুর ভাইকে ডাক দিলেন। মেয়েটির বয়স পনের/ষোল হবে, ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভাই আপনাদের বাসায় নাকি একজন লোক আসছে? তিনি নাকি সাইকেলে বাংলাদেশ ঘুরতে বের হয়েছেন? উনাকে দেখার আমার খুব ইচ্ছা, উনাকে তো মনে হয় ইত্যাদিতেও দেখাইতে পারে।’

আমিনুর ভাই আমাকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন এই যে উনিই। মেয়েটি একদমই অপ্রস্তুত ছিল, আমার দিকে একবার তাকিয়ে লজ্জা পেয়ে দৌড়ে বাড়ির ভিতরে চলে গেল। আমিনুর ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ভাই আপনে কিন্তু বিখ্যাত হয়ে গেছেন। এলাকার অনেকের কাছেই এই খবর ছড়িয়ে গেছে।’ আমি নিজেই নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এইসব কি ঘটছে!

আমরা খাওয়াদাওয়ার পর বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। এমন সময় পাশের বাসা থেকে আমিনুর ভাইয়ের খালা এসে হাজির। তিনি তাঁর ছেলেকে নিয়ে এসেছেন। আমার সঙ্গে একটা ছবি তুলতে হবে। পাশপাশি তিনি নিজেও এসেছেন আমাকে দেখার জন্য। মানুষের আগ্রহ যে কত বিচিত্র হতে পারে আমার ধারণাই ছিল না। আমাকে দেখার জন্য একজন মানুষ তাঁর ছেলেকে নিয়ে আসবে এই ঘটনা পথে বের হওয়ার আগে চিন্তাই করিনি।

খাওয়ার সময়ই বলে দিয়েছিলাম আমি খুব ভোরে চলে যাব। আমার জন্য যেন সকালের খাবারের ব্যবস্থা না করা হয়। কিন্তু আমিনুর ভাই জানিয়ে দিলেন কোন সমস্যা হবে না খালাম্মা ভোরেই উঠেন। আর আমাকে বলে দিলেন উনি একটু ধার্মিক মাইন্ডের তাই আমার সামনে একবারও আসেন নাই। আমি যেন কিছু মনে না করি। আমার অবশ্য এতে কিছু মনে করার নাই। তবে তাঁর মাধ্যমে খালাম্মাকে সালাম জানিয়ে রেখেছিলাম।

Comments

comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.