লিওনেল টেরি ১৯২১ সালের ২৫ জুলাই ফরাসির একটি বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এমন একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন যে তার পরিবার কখনও চিন্তাও করতে পারেননি লিওনেল টেরির এই যাযাবর জীবন। তরুণ বয়স থেকেই তিনি পাহাড়-পর্বতের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেন। স্কিইং দিয়েই তিনি তার জীবনের অ্যাডভেঞ্চার শুরু করেন।
১৯৫৫ সালে প্রথম হিমালয়ের মাকালুতে পদার্পন করেন। আর এই আরোহনে তার সাথে ছিল ফরাসির বিখ্যাত পর্বতারোহী ও গাইড জিন কৌজি। তিনি এবং ইতালির জনপ্রিয় পর্বতারোহী গুডো ম্যাগনন ১৯৫২ সালে পাতাগোনিয়ান আন্দিজের সেরো ফিটজরোয়ে আরোহন করেন।
যদিও টেরি একজন পর্বতারোহী ও স্কি প্রশিক্ষক তবুও তিনি দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় জার্মানির বিরুদ্ধে পর্বত যুদ্ধে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। যুদ্ধের পরে তিনি অন্যতম সেরা চ্যামোনিক্স পর্বতারোহী এবং গাইড হিসেবে সুপরিচিতি লাভ করেন। তাছাড়া তিনি ফরাসি, ইতালিয়ান এবং সুইস আল্পসের কয়েকটি অত্যন্ত বিপর্জ্জনক পাহাড়ের চূড়ায় আরোহন করেন এবং তিনি খ্যাতির শীর্ষে উন্নিত হন। এই পর্বতগুলোর মধ্যে রয়েছে গ্র্যান্ডস জোরাসেসের ওয়াকার স্পার, আইগুইল নোয়ার ডি পিউট্রেয়ের সাউথ ফেইস, পিজ বাদিলের নর্থ-ইস্ট ফেইস এবং আইগারের নর্থ ফেইস।
দ্রুতগামী পর্বতারোহী হিসেবে লিওনেল টেরি বেশ বিখ্যাত ছিলেন। আর এর ফলস্বরূপ তিনি তার পার্টনার লুই ল্যাচেনাল পূর্বের দ্রুতগামী ক্লাইম্বারদের রেকর্ড ভেঙ্গে দেন। লিওনেল টেরি ১৯৫০ সালে নেপালের হিমালয়ে আরোহনকারীদের মধ্যে একজন ছিলেন। তারা প্রায় ৮,০০০ মিটার উচ্চতার চূড়ায় আরোহণ করেন। তবে ১৯২০ এর দশকের দিকে ব্রিটিশ পর্বতারোহী জর্জ ম্যালোরি, অ্যান্ডু ইরভিন, জর্জ ফিঞ্চ, জেফ্রি ব্রুস, হেনরি মোরশেড, টেডি নর্টন এবং হাওয়ার্ড সোমারভেল এই উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন। সেই সময় টেরি অন্নপূর্ণার শীর্ষে পৌঁছাতে পারেননি, তবে তিনি শেরপা আদিজিবার সাথে সার্মিট করা মরিস হার্জোগ এবং লই ল্যাচেনালকে পাহাড়ের উপর থেকে নিচে নামতে সহায়তা করেছিলেন। হার্জোগ এবং ল্যাচেনালের সেই সময় চরম ফ্রস্টবাইট হয় এবং পরবর্তীতে সেই জায়গাগুলো কাটতে হয়েছে। যদিও তাঁদের এই অভিযান পুরোপুরি সফল হয়নি তবুও তাঁরা ফরাসির জনসাধারণের কাছে বেশ প্রশংসিত হন। আর হার্জোগের এই অভিযানের বই ‘অন্নপূর্ণা’ একটি আন্তর্জাতিক বেস্ট সেলার বই হয়ে উঠে।
আইগারের নর্থ ফেইসে ১৯৫৭ সালে আটকে পড়া চারজন আরোহীকে উদ্ধার করার কাজে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে টেরি অন্যতম। জ্যাক অলসেনের বিখ্যাত বই ‘দ্যা ক্লাইম্ব আপ টু হেল’ এ টেরির দক্ষতা ও সাহসীকতার বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া আছে। ১৯৫০ সালের শেষের দিকে এবং ১৯৬০ সালের প্রথম দিকে প্রথম আরোহণকারী হিসেবে পেরুর অনেকগুলো পাহাড় জয় করেন লিওনেল টেরি। এবং আন্দিজের অনেক উচ্চতার নয় কিন্তু অনেক বেশি বিপজ্জনক পাহাড়ে আরোহণ করেন তিনি। তিনি উইলকা উইকি, সরে, টওলিরহু এবং চক্ররাজুসহ আরো কঠিন পর্বতের শীর্ষে আরোহণ করেছিলেন এবং বলা হয়ে থাকে তখনকার সময়ে এইগুলো পেরু আন্দিজের আরোহনের অনুপযোগী পর্বত হিসেবে পরিচিত ছিল।
টেরির অন্যতম সেরা সাফল্য ছিল ১৯৬২ সালে নেপালের ফুট জান্নুর ২৫,২৯৫ ফিট উচ্চতায় প্রথম আরোহণ। এছাড়া তিনি ১৯৬৪ সালে অন্নপূর্ণার নিকটবর্তী নীলগিরিতে আরোহন করেন।
লিওনেল টেরি ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৬৫ সালে ভারকর্স, সাউথ গ্রেনোবেলে রক ক্লাম্বিং করার পর মারা যান। এটাই ছিল তাঁর জীবনের শেষ পর্বতারোহণ। তিনি অনেক ভাল মাউন্টেনিয়ার থেকেও বেশি সাহসীকতার কাজ করে গেছেন তাঁর স্বল্প জীবনে।
তাঁর বিখ্যাত উক্তি হল–‘আমি যখন বৃদ্ধ এবং ক্লান্ত হব, তখন পশু ও ফুলের মধ্যে শান্তি খুঁজে নিব।’
সূত্র:
১। en.wikipedia.org/wiki/Lionel_Terray
২। www.facebook.com/hacemoscumbre/photos/a.1923081514419471/1923082407752715/?type=3&theater
ফিচার ছবি: ইন্টারনেট
তর্জমা: সুরাইয়া বেগম