‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া।’ এই লাইনকে মিথ্যে করার জন্য প্রায় ৫ বছর আগে সাইকেল নিয়ে বের হয়েছিলাম তেতুলিয়া থেকে টেকনাফ দেখার জন্য। সেই থেকে সাইকেলে চরে দেশ দেখা শুরু। রামনাথ বিশ্বাস অথবা বিমুল মুখার্জির মতো পৃথিবী ঘুরতে না পারলেও, নিজের দেশটাকে সাইকেলে ঘুরে দেখাটা নেশায় পরিনত হয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকলো সাতক্ষীরার ভোমরা থেকে সিলেটের তামাবিল বর্ডার পর্যন্ত একটা সাইকেল ভ্রমণের। সঙ্গী খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম নিয়াজ ভাইকে। নিয়াজ ভাইও সঙ্গী খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলেন আমাকে। সঙ্গে আমরা বোনাস হিসেবে পেলাম শেষ সময়ে লিপু ভাইকে। আর্থিক সহযোগীতার জন্যও পেয়ে গেলাম ট্রেকার্স বিডিকে। শেষ সময়েও আরো কিছুটা সহযোগীতার জন্য পেয়ে গেলাম মাহমুদ ভাই ও পিক৬৯ কে। সময় হিসেবে বেছে নিলাম ঈদের ছুটিকে। ঈদের তিন দিন আগে রওনা দেব ঠিক করে টিকেটও কেটে ফেললাম। যথাসময়ে বাসে উঠার জন্য কল্যাণপুরে বাস স্ট্যান্ডে উপস্থিত হলাম আমি আর লিপু ভাই আর যথারীতি নিয়াজ ভাই লেট, হিসাব করে দেখা গেল নিয়াজ ভাই সঠিক সময়ে বাস ধরতে পারবেন না। তাই তিনি গাবতলী রওনা দিয়ে দিলেন, সেখান থেকেই বাসে উঠলেন। আমাদের সাইকেল আগেই এসএ পরিবহনের মাধ্যমে সাতক্ষীরা পাঠিয়ে দিয়েছি।
সকালে বাস থেকে যখন নামলাম তখন আকাশ মেঘলা। এসএ পরিবহন থেকে সাইকেল ছাড়িয়ে রওনা দিলাম ভোমরা সীমানার দিকে। ভোমরা জিরো পয়েন্ট থেকে ছবি তুলে রওনা দিলাম খুলনা শহরের উদ্দেশ্য। পথে লোকজন থামিয়ে থামিয়ে জিজ্ঞেস করছে, ‘ভাই ঘটনা কি? কই যাবেন?’ উত্তর শুনে তো ‘থ! নিয়াজ ভাইয়ের কাছ থেকে এক লোক বিস্তারিত শুনে সাতক্ষিরার ভাষায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারো কি ঈদেও সাইকেল চালাবেন?’ নিয়াজ ভাইয়ের উত্তর, ‘হুম’; অপরিচিত লোকের উত্তর, ‘তা হলি তো পারি আপনাগি ঈদি মাটি হই গেল!’ এই ধরনের মজার মজার ঘটনার মধ্যেই চুকনগরের বিখ্যাত ‘চুইঝাল’ খেয়ে খুলনা শহরে যখন পৌঁছালাম রাতে। সেখানে থাকার ব্যবস্থা হলো নিয়াজ ভাইয়ের বন্ধু সোহেল ভাইয়ের বাসায়। খুলনার জেলখানা ঘাট থেকে নৌকায় করে সোহেল ভাইয়ের বাসায় পৌঁছালাম। বাড়ি দেখে তো সবাই অবাক, বিশাল এক রাজ-প্রাসাদ বানিয়ে রেখেছেন।
রাজপ্রাসাদ থেকে ঘুম থেকে উঠে রওনা দিতে দিতে অনেক বেলা হয়ে গেল। আমাদের আজকের গন্তব্য ভাঙ্গা, দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার। সোহেল ভাইয়ের কাছ থেকে গোপালগঞ্জ যাওয়ার একটা শর্টকাট রাস্তা জেনে নিলাম, আমাদের উদ্দেশ্য ছিলো বিশ্বরোড দিয়ে না যেয়ে গ্রামের ভিতর দিয়ে যাওয়া। সোহেল ভাইয়ের বাসা থেকে বের হতে যাব ঠিক তখনই লিপু ভাইয়ের সাইকেলের পিছনের চাকা বাস্ট হলো, তাই নতুন একটি টিউব লাগিয়ে আমরা রওনা দিলাম। পথে দুইবার ঝুম বৃষ্টির জন্য থামতে হলো, এরপর যে কয়েকবার থামলাম বেশির ভাগই ছবি তোলা আর নামাযের জন্য। গোপালগঞ্জ ঢুকে মনে হল যেন উন্নত কোন এক শহরে এসেছি। গোপালগঞ্জ থেকে টেকের হাটের রাস্তা ধরে চলতে থাকলাম ভাঙ্গার উদ্দেশ্যে। এখানে আমরা বিশ্বরোডকে এড়িয়ে গেলাম ফলশ্র“তিতে পেলাম অদ্ভূত সুন্দর নদীর পাড় ধরে ধরে সুন্দর রাস্তা। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কম, তাই আমাদের চলতে সুবিধা। ইফতারের ঠিক পরপরই আমরা পৌঁছে গেলাম ভাঙ্গায়। ভাঙ্গায় থাকার ব্যবস্থা হলো লিপু ভাইয়ের খালার বাসায়, লিপু ভাই তাঁর খালার বাসায় এসেছেন বহু বছর পর। তাঁর খালাতো ভাই ভেবেছিলেন আমরা মোটর সাইকেলে আসছি, কিন্তু আমাদের সঙ্গে সাইকেল দেখে তিনি অবাক। বহু বছর পর বেড়াতে আসার সুবাধে আমাদের খাওয়া-দাওয়াও হলো সিরাম।
তৃতীয় দিনের শুরু হলো ঢাকার উদ্দেশে, পথে মাওয়া ফেরি পার হতে হবে। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা অনেক বেশি, সবাই ঈদ করার জন্য বাড়ি ফিরছে। আগামীকাল ঈদ তাই রাস্তায় এত গাড়ি, পাওয়া পৌঁছানোর আগে রাস্তায় দুটি এক্সিডেন্ট এর পরের ঘটনা দেখলাম। একটা বাস আর মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ। আরেকটা নসিমন আর বাসের সঙ্গে সংঘর্ষ। মাওয়া পৌঁছাতে না যত সময় লাগলো তার চাইতে বেশি সময় লাগলো ফেরিতে উঠতে। কারণ অনেক ভিড়। ঐ পাড়ে নেমেই ভিড় ঠেলে রওনা দিলাম ঢাকা শহরের দিকে। সন্ধ্যায় লিপু ভাইয়ের বাসায় ইফতার করে তার রওনা দেব শাহবাগের উদ্দেশে। আর ঈদের দিনও সকালে খাওয়া-দাওয়া করবো লিপু ভাইয়ের বাসায়। ইফতারের ঠিক আগ মূহুর্তে পৌছে গেলাম লিপু ভাইয়ের বাসায়। ইফতার শেষ করে শাহবাগ ট্রাভেলার্স অব বাংলাদেশের আড্ডায়। এর মধ্যে নিয়াজ ভাই একটি আন-স্মার্ট থেকে স্মার্ট উপনিত হলেন মানে একটি স্মার্ট কিনে ফেললেন। আর পরবর্তী কয়েকটা দিন আমাদের খবর সরাসরি ফেসবুকে দিয়ে দেয়ার একটি মাধ্যমও তৈরি হয়ে গেল। আড্ডা শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ১১ টা বেজে গেল।
সকালে ঘুম থেকে উঠে ঈদের নামায শেষ করে রওনা দিলাম লিপু ভাইয়ের বাসায়। সেখানে ইচ্ছামত পোলাও, মাংস খেয়ে রওনা দিলাম আমাদের পরবর্তী অংশ শেষ করার জন্য, আমাদের আজকের উদ্দেশ্য ভৈরব। রাস্তা একদম ফাঁকা, তবে মাথার উপর প্রচণ্ড রোদ। গত তিনদিন আকাশ মেঘলা ছিল, কিছুটা বৃষ্টিও হয়েছে। কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই চলছিলাম। একজন আরেকজনের সঙ্গে নানা রকম গল্পের মাঝে শুনলাম সদ্য চায়না থেকে ফিরে আসা লিপু ভাইয়ের চায়নার কিছু গল্প এবং জানতে পারলাম নতুন কিছু তথ্য। লিপু ভাই চায়নায় গিয়ে গুরুত্বপূর্ন একটি প্রাণি দেখেছেন, সেই প্রাণির নাম পান্ডা। তাঁর কাছ থেকে পান্ডার কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও জানতে পারলাম। পান্ডা এখন আস্তে আস্তে কমতে কমতে বিরল প্রাণিতে পৌঁছে যাচ্ছে। পান্ডা খাওয়ার মধ্যে খায় কচি বাঁশ। এরা প্রচণ্ড রকম অলস হয়ে থাকে। এরা এতই অলস যে নিজেদের মধ্যেও একজন আরেকজনের সঙ্গে মিলিত হতে চায় না। সেই কারণে এদের বংশ বৃদ্ধিও অনেক কমে যাচ্ছে দিন দিন। তাই বাধ্য হয়ে এদেরকে টিকিয়ে রাখার জন্য অতিমাত্রার ভায়াগ্রা খাইয়ে বংশ বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। এই ধরনের মজার মজার অজানা গল্প শুনতে শুনতে একসময় পৌঁছে গেলাম ভৈরব শহরে। ভৈরবে উঠলাম একটি হোটেলে। আমাদের জন্য আগে থেকেই সেখানে অপেক্ষা নাঈম ও শরীফ নামে দুইজন। রাতে ভৈরব ব্রীজের নিচে পাথরের উপর ও ব্রীজের উপর বসে বসে গান শুনলাম স্থানীয় শিল্পীদের।
একটু ভোর থাকতে থাকতেই সবাই উঠে রওনা দিলাম। কারণ আজকে অনেক দূর যেতে হবে প্রায় ১২০ কিলোমিটারের উপরে। ভৈরব সেতুতে সেতু কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে রওনা দিলাম। সেতু পার হয়ে নাস্তা করলাম উজানভাটি রেস্তোরায়। পথে কোন ঝামেলা ছাড়াই সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে শ্রীমঙ্গল শহরে ঢুকে পরলাম। আজ আর মাত্র ১৮ কিলোমিটার চালালেই আমাদের আজকের দিনের মতো সাইকেল চালানো শেষ। তবে আমরা শ্রীমঙ্গলে বিশাল একটি বিরতী দিলাম, কুটুম বাড়িতে সন্ধ্যায় খেলাম দুপুরের খাবার। সেখানে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন পুশান ভাই আর তার বন্ধুরা উনারা অনেক আগেই শ্রীমঙ্গলে এসেছেন, তারা মূলত থাকে মৌলভীবাজারে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমরা আবার সাইকেলে উঠে রওনা দিলাম। মৌলভীবাজারে ঢোকার মাত্র ৬/৭ কিলোমিটার আগে শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি। ছোট্ট একটি দোকানে সবাই মিলে আশ্রয় নিলাম। প্রায় ২ ঘণ্টা বসে থাকার পরও বৃষ্টি থামার নাম নেই। সিদ্ধান্ত নিলাম এই বৃষ্টিতেই রওনা দেব, যদি সারা রাত বৃষ্টি হয় তো এখানে বসে থাকার কোন মানে হয় না। তা ছাড়া মৌলভীবাজারে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন পুশান ভাই ও মিশা ভাই। আজকে রাতে মিশা ভাইয়ের বাসায় থাকবো ঠিক করা হয়েছে। মৌলভীবাজারে পৌঁছাতে পৌঁছাতে অনেক রাত হয়ে গেল। একটি হোটেলে খাওয়া শেষ করতে করতে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন মৌলভীবাজারের ছেলে রাহী ভাইও। কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে পৌঁছালাম মিশা ভাইয়ের বাসায়। সেখানে সব কিছু রেখে রাত ১২ টার নামলাম পুকুরে গোসল করার জন্য তখনও ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পরছে। পুকুরে প্রায় রাত ২ টা পর্যন্ত দাপাদাপি করলাম। ঘুমুতে ঘুমুতে রাত ২.৩০ মিনিট।
দেরিতে ঘুমানোর কারণে সকালে উঠতেও সামান্য দেরি হলো। মিশা ভাইয়ের বাসায় খিচুরি দিয়ে নাস্তা শেষ করে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে গেলাম। আজকে আকাসের অবস্থা খুব একটা ভাল না, গত রাতে সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। বের হওয়ার সময় ঠিক করে নিয়েছি যত বৃষ্টিই হোক আজকে বৃষ্টির মধ্যেই চালাবো। আজকে আমরা মৌলভীবাজার সিলেটের মূল রাস্তা বাদ দিয়ে ফেঞ্চুগঞ্জের রাস্তা দিয়ে রওনা দিলাম। পথে ভৈরবের নাঈমের ফোন পেলাম, তিনি কাঁধে বেগ নিয়ে বের হয়ে গেছেন হেঁটে হেঁটে সিলেটের পথে। ভৈরবে আমাদের দেখেই তার মাথার মধ্যে এসেছে তারও একটা কিছু করতে হবে! শাহপরানের মাঝারের কাছ যেতে যেতে ঝুম বৃষ্টির পাল্লায় পরলাম। ভিজতে ভিজতেই আমরা সামনে এগিয়ে যেতে থাকলাম। জালালাবাদ কেন্টমেন্ট স্কুল ও কলেজের কাছে একটি বাজারে ডিম আর পরাটা দিয়ে দুপুরের খাবার খেলাম। পথে সিলেটের দুই সাইক্লিস্টের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করলাম আমি আর লিপু ভাই। আর নিয়াজ ভাই সবসময় ঘণ্টায় ২০/২৫ কিলোমিটার বেগে সামনে এগিয়ে থাকেন ধরা ছোয়ার বাইরে। সন্ধ্যার দিকে লিপু ভাইয়ের পেছনের চাকা দ্বিতীয়বারের মতো পাংচার হলো। থেকে টিউব পাল্টে ফেললাম। মোহাম্মদ ভাইয়ের অফিসের ফেক্টোরি টিএসসিও পাওয়ার লিঃ-এ থাকার ব্যবস্থা করে রেখেছেন মোহাম্মদ ভাই। ফেক্টোরিটির দূরত্ব তামাবিল বর্ডারের ঠিক ৩ কিলোমিটার আগে। কিন্তু স্থানীয় লোকজন এই নামে ফেক্টোরিটি চেনে না। সবাই চেনে খাম্বা ফেক্টোরি নামে। কারণ এই ফেক্টোরিতে বিদ্যুতের খাম্বা তৈরি করা হয়। আমরা খাম্বা ফেক্টোরিতে পৌঁছালাম রাত ৮ টার পরে। রাতে খাওয়াদাওয়া তারপর পুকুরের গোসল করা, ১২ টার পরে বারবিকিউ পার্টি। সব মিলিয়ে অসাধারণ।
ইচ্ছা ছিলো খুব ভোরে রওনা দেব, কিন্তু বৃষ্টির কারণে বের হওয়া গেল। সকালে নাস্তা হিসেবে খিচুরি খেয়ে রওনা দিলাম আমাদের শেষ গন্তব্য তামাবিল। তামাবিল শেষ গন্তব্য হলেও আমরা তামাবিল এর পরে জাফলংয়েও যাব। এত কাছে জাফলং না গেলে ভ্রমণটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তামাবিল পৌঁছে কিছু ছবি তুললাম, তারপর জাফলং। জাফলংয়ে খুব ভালো কিছু সময় কাটিয়ে, সিলেটের পথ ধরলাম, তবে সাইকেলে না একটি পাথরের ট্রাকে। সিলেটে পৌঁছে রুবেল ভাইয়ের বদৌলতে বাংলাদেশ বেতার সিলেটের অফিসও দেখার সৌভাগ্য হলো।
সাতক্ষীরার ভোমরা থেকে সিলেটের তামাবিল এর রুট প্ল্যান।
প্রথম দিন: সাতক্ষীরা > ভোমরা > সাতক্ষীরা > খুলনা > ৮৯ কিলোমিটার
দ্বিতীয় দিন: খুলনা > ভাঙ্গা > ৯৮ কিলোমিটার
তৃতীয় দিন: ভাঙ্গা > ঢাকা > ৬৩ কিলোমিটার
চতুর্থ দিন: ঢাকা > ভৈরব > ৭৩ কিলোমিটার
পঞ্চম দিন: ভৈরব > মৌলভীবাজার > ১২১ কিলোমিটার
ষষ্ঠ দিন: মৌলভীবাজার > তামাবিল (০ পয়েন্ট থেকে ৩ কিলোমিটার আগে) > ১০১ কিলোমিটার
সপ্তম দিন: তামাবিল (০ পয়েন্ট থেকে ৩ কিলোমিটার আগে) > তামাবিল ০ পয়েন্ট > জাফলং > ৯ কিলোমিটার
সহযোগীতায়: ট্রেকারস বিডি ও পিক ৬৯
Awesome… journey life is a better life 🙂
আহ! অপেক্ষায় আছি,কবে বেরিয়ে পড়বো…