আমার সাইকেল চালানো শেখা হয়েছিল অনেকটা ইগোয়েটিক সমস্যা থেকে।
আমরা সব সময় ভাড়া নিয়ে তারপর সাইকেল চালাতাম, নিজেদের কারোই সাইকেল ছিল না। আমি নিজে সাইকেল চালাতে পারতাম না। বন্ধুরা ভাড়া নিত, সেই সাইকেলে উঠার সুযোগ পেতাম, মাঝে মাঝে ভাড়ার একটা অংশ আমাকেও দিতে হইত। আমরা এক সাইকেলে তিনজন এমনকি চারজনও উঠতাম। এখন ভাবতেই অবাক লাগে। তখনকার সময় সাইকেল ভাড়া ছিল আধা ঘণ্টা তিন টাকা আর এক ঘণ্টা পাঁচ টাকা। ঈদের সময় ভাড়া ডাবল হয়ে যেত।
সাইকেল চালাতে জানতাম না বলে অনেক বন্ধুদের কাছে নিজেকে ছোট মনে হইত। মনে হইত ও সাইকেল চালাতে পারে আমি পারিনা, বিষয়টা খুবই হতাশাজনক, অপমানজনকও বটে। এমনও হয়েছে পুরা সময়ের ভাড়া আমি দিচ্ছি কিন্তু বন্ধুটা শুধু সাইকেল চালানো জানে বলে ভাড়া না দিয়ে আমাকে নিয়ে ঘুরতেছে।
এলাকায় এক বড় ভাই ছিলেন একটু বাটপার টাইপের। নাম মোজাম্মেল, আমরা সেই নাম সংক্ষেপ করে মুজি ভাই ডাকতাম। উনি এমন কোন কাজ নাই মনে হয় করতেন না। সারা সপ্তাহ স্টুডেন্ট পড়াতেন ব্যাচ করে। আবার বাসায় গিয়ে পড়াতেন। এ ছাড়াও সপ্তাহে দুইদিন বিকালে বৃহস্পতি আর শুক্রবার আরবী পড়াতেন। বাসায় একটা কম্পিউটার ছিল সেটা দিয়ে কম্পিউটারও শিখাতেন। কম্পিউটার শিখানো বলতে এ বি সি ডি কম্পোজ করা শেখানো আর কপি-পেস্ট শেখানো। আর বছর শেষে স্কুলে যারা ফেল করতো টাকার বিনিময়ে উপরের ক্লাশে ভর্তি করিয়ে দিতেন। এসএসসি টেস্টে কেউ ৬/৭ বিষয়ে ফেল করলেও তিনি ফাইনাল পরীক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারতেন, বিনিময়ে টাকা নিতেন। তাই উনার স্টুডেন্টরাও ছিল ঐ টাইপেরই। যেমন আমার মতো খারাপ ছাত্র, যদিও তাঁর কাছে আরবী ছাড়া অন্য কিছু পড়া হয় নাই। উনার সম্পর্কে আরো বিস্তারিত আরেকদিন লিখতে হবে।
হঠাৎ একদিন দেখা গেল মুজি ভাই নানারকম খেলনার জিনিশপত্র আনলেন। তাঁর কোন এক বন্ধু নাকি জাপান থেকে এইসব জিনিশপত্র উনাকে দিয়েছেন বিক্রি করার জন্য। আর সঙ্গে একটা ফোল্ডিং সাইকেল। সেইসব খেলনা থেকে আমি দুইটা বল কিনেছিলাম বিশ টাকা দিয়ে একটা লাল আরেকটা হলুদ। বলগুলা প্লাস্টিকের হইলেও অনেক শক্ত এত শক্ত বল আমি আর কোথাও দেখি নাই।
আর যে সাইকেলটা এনেছিলেন সেই সাইকেলও আগে কখনো দেখি নাই। যে সময়কার ঘটনার কথা বলতেছি সেটা ৯৪/৯৫ সালের হবে অথবা ৯৫/৯৬ সালের কথা হবে। একে তো ফোল্ডিং সাইকেল আরেকটা বিষয় ছিল সাইকেলের কোন ব্রেক ছিল না। পিছনে প্যাডেল দিলে সাইকেল থামত। এখন বুঝতে পারি এটা অনেকটা ফিক্সি টাইপের সাইকেল ছিল ওটা। আমি আর ফোল্ডিংওয়ালা ফিক্সি টাইপের সাইকেল এখন পর্যন্ত দেখি নাই। হয়তো সামনে দেখা হলেও হতে পারে। মুজি ভাই সেই সাইকেলটা নিয়মিত ভাড়া দিতেন।
আমি যেসব বন্ধুদের সাথে বেশি ঘুরতাম তার মধ্যে রাজিব ছিল অন্যতম। হঠাৎ রাজিবরা একবার বিক্রমপুর গেল বেড়াতে। তখন মুজি ভাইয়ের কাছ থেকে আমরা মাঝে মাঝে সাইকেল ভাড়া নিতাম। একে তো বাসার কাছেই একদম এগার নাম্বার গলিতেই ছিল মুজি ভাইয়ের বাসা আর নতুন জাপানী সাইকেল, তাই ভাবই আলাদা। আর তাই এই সাইকেলের প্রতি আমাদের অনেক আকর্ষণ ছিল। আরেকটা জায়গা থেকে আমরা সাইকেল ভাড়া নিতাম, সেটা হইল নাবিস্কো মোড়ের রহিম ভাইয়ের দোকান থেকে।
রাজিবরা বেড়াতে যাওয়ার পর পরই মনে হইল আমি একা একা সাইকেল চালানো শিখে ফেলবো। তারপর রাজিবকে সারপ্রাইজ দিতে হবে। মুজি ভাইয়ের কাছ থেকে সাইকেল ভাড়া নিয়ে গলিতেই দেয়াল ধরে ধরে একা একা চালানো শেখার চেষ্টা করতে থাকলাম। ভাড়া নিতাম একদম দুপুরে, তখন গলিতে কোন লোকজন ছিল না। টাকা না থাকার কারণে প্রতিদিন তো আর ভাড়া নেয়া যেত না, যখনই টাকা ম্যানেজ করতে পারতাম তখনই চেষ্টা করতাম। রাজিবরা ঢাকায় আসতে আসতে আমি একটু একটু চালাতে শিখে গেছি। চালাতে পারি বলতে একটু সামনে যেতে পারি। কিন্তু একটু পরেই পড়ে যাই।
আর মোড় ঘুরতে কখনই ব্যালেন্স রাখতে পারতাম না। একদিন তো এক মহিলার উপর পড়েই গেলাম। মহিলা মাথার মধ্যে থাপ্পর দিয়া চলে গেছিল। এর বেশি কিছু করেন নাই। যেহেতু বাচ্চা ছিলাম মাত্র তৃতীয় কি চতুর্থ শ্রেণিতে পাড়ি। বাচ্চা ছেলেটাকে মারতেও মনে হয় উনার মায়া লাগতেছিল। আর সম্ভবত আমার চেহারাও হয়তো কিছুটা ইনোসেন্ট টাইপের ছিল।
যাই হোক ঐটুকু বিদ্যা দিয়েই রাজিব ফিরে আসার পরে খুব ভাব নিয়া বলে দিলাম শুধু তুই না আমিও সাইকেল চালাতে পারি। কিন্তু দেখা গেল সাইকেল ভাড়া নিলেও আমি চালাই না। রাজিবই চালায় বেশি আমি সামনে রডের উপর বসে থাকি। জিজ্ঞাসা করলে বলি মাত্র শিখছি ডাবলিং পারি না।
একদিন আমরা শাহিনবাগ গিয়েছি সাইকেল চালাতে চালাতে। হঠাৎ রাজিব সাইকেল দিয়ে বলে চালিয়ে দেখা। আমি পড়লাম বিপদে, আল্লাহর নাম নিয়া প্যাডেল দিয়া দেখি সত্যি সত্যি পারতেছি এখানেও। আগে তো দেয়াল ধরে ধরে চালাতাম কিন্তু এই খোলা জায়গায় তো কোন দেয়াল নাই। যথারীতি কিছুদূর যাওয়ার পরে পড়ে গেলাম। কিন্তু একটু যে চালাতে পারি সেটার ভাবও আমার কম ছিল না।
এভাবেই আস্তে আস্তে একদিন সাইকেলও ঘুরাতে শিখে গেলাম। ডানে বামে যেতেও এক সময় আর সমস্যা হইল না। তারপর ঐ বয়সেই রাস্তায় নেমে গেলাম। আর যাঁরা ভাড়া করা সাইকেল চালাইছেন তারা মনে হয় জানেন অনেক সাইকেলেই ব্রেকের কোন বালাই ছিল না। আমাদের পা-ই ছিল সবচাইতে বড় ব্রেক। তবে এখন যদি আমাকে ব্রেক ছাড়া সাইকেল চালাতে দেয় আমি মনে হয় জীবনেও চালাতে পারবো না।
বলা যায় সাইকেল চালানো আমি নিজে নিজেই শিখেছি। এবং একা একা সাইকেল চালানো শেখাটা খুব বেশি কঠিন কিছুও না। বয়স বেশি হলে অবশ্য একটু কঠিন হয়ে যায়, কারণ তখন মনের মধ্যে ভয় ঢুকে যায়, কিন্তু কঠিন কিছু না। আমি অনেককে একদিনেই সাইকেল চালানো শিখিয়ে দিয়েছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় তাঁরা আর কন্টিনিউ করেন নাই। তবে ছোট বেলায় যদি কেউ সাইকেল চালানোটা শিখে ফেলতে পারে তাহলে খুব ভাল হয়।
সবাই চেষ্টা করবেন নিজের সন্তান, ভাতিজা-ভাতিজী, ভাগিনা-ভাগিনী থাকলে নিজ দায়িত্বে সাইকেল চালানো এবং সাঁতার দুইটাই শিখিয়ে দিতে। এতে তাঁদের ভবিষ্যতটা অনেক ভাল হবে, অনেক সুবিধাজনক হবে।
২৯ শ্রাবণ ১৪২৭